মহাকাশযানে চড়ে নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে উড়ে বেড়াবার দিন এসে গেছে কি?

নাসা’র নিউ হরাইজন নামের মহাকাশযান যে ডরফ গ্রহ প্লুটোকে পেড়িয়ে আমাদের সৌরজগতের শেষ সীমান্তের (কুইপার বেল্ট) দিকে প্রোব চালাচ্ছে সে খবর অনেকেই জানেন। এই খবর শুনে স্টার ট্রেক নেক্সট জেনারেশন ভক্তদের নিশ্চয়ই স্পেস ট্রাভেল (মহাশূণ্য ভ্রমণ) নিয়ে চিন্তাগুলো আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে? কিন্তু সত্যিই কি মানুষ মহাকাশে ভ্রমণ করার মতো প্রযুক্তি বা মহাকাশযান তৈরি করতে পেরেছে? আমাদের জীবদ্দশায় কী দেখে যেতে পারবো যে নিজেদের সৌরজগত পেড়িয়ে আমরা অন্য সৌরজগতে ভ্রমণ করতে পারছি? আমাদের সৌরজগতের সবচে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেনটাওরি বা আলফা সেন্টাওরিতে ভ্রমণ করতে কতোদিন লাগবে সেটা হিসেব করে বের করলেই আমাদের প্রশ্নের উত্তরটি সহজে পেতে পারি।

এ উত্তর না খুঁজেও এখন আর উপায় নেই কেননা মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে একদিন না একদিন আমাদের প্রিয় এই সৌরজগতকে ছেড়ে যেতেই হবে। আমাদের ওযোন লেয়ার ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে আসছে এবং সূর্যের অতি বেগুণী রশ্মীর বিকিরণের ঝূঁকির সম্মুখীণ হচ্ছি আমরা। যে কারণে ক্যানসার রোগেরও পাদুর্ভাব বাড়ছে। আমরা সবাই জানি সূর্যকে একটি নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর বললে ভুল হবে না। আর নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরের রেডিয়েশন যে কতোটা ক্ষতিকর হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়। অন্যদিকে পৃথিবীর সুপেয় পানির এক তৃতীয়াংশ ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। এন্টার্কটিকায় গলে যাচ্ছে বরফ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে, সিসমিক এ্যাক্টিভিটিও বেড়েছে। প্রায়ই পৃথিবীর এখানে ওখানে ভূমিকম্প হচ্ছে।

এসবেরই সূত্র ধরে মার্স ওয়ানের যাত্রা। মঙ্গল গ্রহে স্থায়ী বসবাসে আগ্রহী নির্বাচিত ১০০ জনের মধ্যে থেকে স্ক্রিনিং করে ২৪ জনকে শেষমেষ ২০২৫- নাগাদ পাঠানো হবে মঙ্গল গ্রহে। অতএব আমাদের জীবদ্দশায় পরিচিতদেরকে মঙ্গলগ্রহে মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটাতে দেখতে পাবো বলে আশা করতে পারি। কিন্তু এই সৌরজগত পেড়িয়ে মহাশূণ্যের আনাচে কানাচে ঘুড়ে বেড়াবার স্বপ্ন কি আমাদের সফল হবে?

এ প্রশ্নের উত্তর জানতে প্রথমেই যেটা জানা প্রয়োজন সেটা হলো পৃথিবী থেকে সবচে কাছের সৌরজগতের দূরত্ব এবং আমাদের আধুনিক স্পেসক্রাফটের স্পিড। লঞ্চের সময় সর্বোচ্চ স্পিডের রেকর্ড করেছিল নাসার স্পেস ক্রাফট নিউ হরাইজন যার স্পিড হলো ৩৬,০০০ মাইল/ঘন্টা। তবে এই মহাকাশযান যখন জুপিটার পার হয়ে যাচ্ছিল তখন গ্রহটির মাধ্যাকর্ষনের ধাক্কায় (স্লিংশট) এর স্পিড ঘন্টায় ৯০০০ মাইল বেড়ে গিয়ে ৪৫,০০০ মাইল/ঘন্টায় উন্নিত হয়। যারা রেসিং গেম খেলেন তারা স্লিংশট টার্মটির সাথে পরিচিত। স্পেস ট্রাভেলের ক্ষেত্রে স্লিংশটকে কমোন একটা ব্যাপারই বলা যায়। যাইহোক, আমরা মাধ্যাকর্ষণ স্লিংশট সংক্রান্ত স্পিড বৃদ্ধিকে বাদ দিয়েই সময় হিসাব করবো। ঘন্টায় ৩৬০০০ মাইল স্পিডে নিউ হরাইজনের কতো সময় লাগবে পৃথিবী থেকে অন্য গ্রহ ছাড়িয়ে প্রক্সিমা সেন্টাওরিতে পৌছাতে?

মহাকাশ বিচরণ

পৃথিবী থেকে (সবচে নিকটবর্তী ও দূরবর্তী অবস্থায়)

মঙ্গল-এর দূরত্ব: ৩৩.৯ থেকে ২৫০ মিলিয়ন মাইল (যাত্রার সময় লাগবে: ৯৪২ ঘন্টা বা ৩৯ দিন থেকে ৬৯৪৪ ঘন্টা বা ২৮৯ দিন)।

বৃহস্পতি-এর দূরত্ব: ৩৬৫ থেকে ৬০১ মিলিয়ন মাইল (যাত্রার সময় লাগবে: প্রায় ৪২২ দিন থেকে ৬৯৫ দিন)।

শনি-এর দূরত্ব: ৭৪৬ মিলিয়ন থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন মাইল (যাত্রার সময় লাগবে: প্রায় ৮৬৩ দিন থেকে ১১৫৭ দিন)।

ইউরেনাস-এর দূরত্ব: ১.৬ থেকে ১.৯৮ বিলিয়ন মাইল (যাত্রার সময় লাগবে: প্রায় ১৮৫১ দিন থেকে ২২৯১ দিন)।

নেপচুন-এর দূরত্ব: ২.৭ থেকে ২.৯ বিলিয়ন মাইল (যাত্রার সময় লাগবে: প্রায় ৩১২৫ দিন থেকে ৩৪৪৯ দিন)।

প্লুটো-এর দূরত্ব: ২.৬৬ থেকে ৪.৬৭ বিলিয়ন মাইল (যাত্রার সময় লাগবে: প্রায় ৩০৭৮ দিন থেকে ৫৪০৫ দিন – বাস্তব ক্ষেত্রে নিউ হরাইজনের প্লুটোতে পৌছাতে সময় লেগেছে ৯ বছর ৭ মাস ২৫ দিন বা ৩৫২০ দিন)

পৃথিবী থেকে সবচে কাছের সৌরজগত প্রক্সিমা সেন্টাওরির দূরত্ব ৪.২২ আলোকবর্ষ বা লাইট ইয়ার; মাইল-এর হিসাবে এটা প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন মাইল (২৫,০০০,০০০,০০০,০০০) দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ নিউ হরাইজনে করে পৃথিবী থেকে প্রক্সিমা সেন্টাওরিতে পৌছাতে সময় লাগবে ২৮৯৩৫১৮৫ দিন বা ৭৯ হাজার বছর। অতএব বোঝাই যাচ্ছে মহাশূণ্য ভ্রমণের ক্ষেত্রে মানবসৃষ্ট স্পেস ক্রাফটের এই স্পিড অবশ্য বর্জণীয় রকমের ক্ষুদ্র! তবে গ্রাভিটেশনাল স্লিংশট বা মহাকর্ষিয় স্লিংশট বা মাধ্যাকর্ষণের ধাক্কায় হেলিয়স ২ নামক স্পেসক্রাফটি সর্বোচ্চ ১,৫০,০০০ মাইল/ঘন্টা স্পিড অর্জনে সক্ষম হয়। কিন্তু সার্বক্ষণিক ১,৫০,০০০ মাইল/ঘন্টা স্পিডেও যদি আমরা কোন স্পেসক্রাফটে যাত্রা করি তবুও পৃথিবী থেকে প্রক্সিমা সেন্টাওরিতে পৌছাতে আমাদের সময় লাগবে প্রায় ১৯০০০ বছর বা ৬০০ জেনারেশন।

oort cloud

তবে থিওরেটিকালি আরও একটি প্রযুক্তিতে দ্রুতগতির স্পেস ট্রাভেল সম্ভব হতে পারে। এই প্রযুক্তির নাম হলো নিউক্লিয়ার পাল্স প্রোপালসন। এই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ১৯৫৮ সালে জন্ম হয় প্রজেক্ট অরিঅন-এর। নিউক্লিয়ার বিষ্ফোরণের মাধ্যমে অর্জিত শক্তি দিয়ে প্রজেক্ট অরিয়ন স্পেসক্রাফটকে চালানো হলে এর সর্বোচ্চ গতি ৩,৩৭,৫০০০০ মাইল/ঘন্টায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে দাবী করা হয়। তবে এই গতিও আলোর গতি(১৮৬০০০ মাইল/সেকেন্ড)-র ১০০ ভাগের ৫ ভাগ মাত্র! এবং ঘন্টায় ৩,৩৭,৫০০০০ মাইল গতিতে গেলেও প্রক্সিমা সেন্টাওরিতে পৌছতে আমাদের সময় লাগবে ৮৫ বছর! অর্থাৎ আমাদের জীবদ্দশায় নতুন কোন সৌরজগত ভ্রমণের খবর জেনে যাওয়ার সুযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া প্রজেক্ট অরিঅনও ক্যান্সেল করা হয়েছে এর ডিজাইনের ভুল এবং প্রচুর পরিমাণ রেডিওএ্যাকটিভ ওয়েস্ট মহাশূণ্যে নির্গমনের আশঙ্কায়।

অর্থাৎ স্টার ট্রেক নেক্সট জেনারেশনের সেই ওয়ারপ ড্রাইভ আর ব্ল্যাক হোল দিয়ে যাতায়াতের সাই-ফাই প্রযুক্তি যতদিন না বাস্তবে পরিণত হচ্ছে ততোদিন ইন্টারস্টেলার ট্রাভেল বা স্পেস ট্রাভেল কী কেবলই একটা স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে?

তবে যে মুহূর্তে আমি এই লেখাটি BengaliReview-এ পাবলিশ করছি তার কিছু আগে বা পড়েই নাসা’র বিজ্ঞানীরা এক অভাবনীয় আবিস্কার করে বসেছে। তারা দাবী করছে পৃথিবীর সমান আকারের একটি গ্রহ খুঁজে পেয়েছে এবং এই গ্রহটিরও আমাদের সূর্যের প্রায় সমান আকারের একটা নক্ষত্রের সৌরজগতে বসবাস। বিজ্ঞানীদের দাবী যে গ্রহটির তাপমাত্রা খুব বেশী গরমও নয় আবার ঠান্ডাও নয়; অতএব এই গ্রহটিতে প্রাণী, এমনকি বুদ্ধিমান প্রাণীর বিকাশ ঘটে থাকা অসম্ভব কিছু নয়। এর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও ততো ক্ষীণ নয় যে চাইলেই আপনি সুপার ম্যানের মতো জাম্প করে আকাশে উড়ে যাবেন, বা ব্যালেন্স করতে সমস্যা হবে কিংবা এতো প্রবলও নয় যে আপনি নড়তেও পারবেন না। কেপলার ৪৫২-বি নামের এই গ্রহটির আবিস্কার ঘটলো রাশান উদ্যোক্তা ইউরি মিলনার এবং কসমোলোজিস্ট স্টিফেন হকিং-এর ’ব্রেকথ্রু লিসেন’ নামের এলিয়েন প্রাণী খোঁজার উদ্যোগ নেয়ার কেবল দুদিনের মাথাতেই।

নাসা এমেস কেপলার মিশনের প্রধান ডেটা এনালিস্ট জন জেনকিনস বলেছেন, ”বসবাসযোগ্যতার মানচিত্রের বোর্ডে আজ প্রথমবারের মতো আমরা একটি পিন স্থাপন করেছি।” অপরদিকে নাসার সায়েন্স মিশন ডাইরেক্টরেট-এর সহকারী এ্যাডমিনেস্ট্রেটর বলেছেন, ”এই আবিস্কার এতোটাই প্রেরণাদায়ক যে বলা যায় পৃথিবী ২.০-কে খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা আরও একধাপ এগিয়ে গেছি।”

তবে এই গ্রহটি এতো দূরে যে এস্ট্রোনোমারদের সবচে শক্তিশালী যন্ত্রপাতিগুলো দিয়েও একে সরাসরি দেখা যায় না। কেপলার স্পেস টেলিস্কোপটিই এর অস্তিত্ব আবিস্কার করেছে। তবে পৃথিবীতে অবস্থিত নাসার মহাকাশ পর্যবেক্ষণ টিমটিও কেপলার ৪৫২বি-এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছে। আশার বিষয় হলো আজকে থেকে মাত্র ৫০০ বছর আগেও মানুষ জানতো না আমেরিকা বলে কোন দেশ আছে। আর আজ সমগ্র পৃথিবী আমাদের হাতের মুঠোও। অতএব প্রক্সিমা সেন্টাওরিতো কাছেই, আমরা নিশ্চয়ই একদিন না একদিন নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে ঘুড়ে বেড়াতে পারবো। এবং সেই দিন খুব বেশী দূরে নয়।

উৎস:

  1. http://www.universetoday.com/15403/how-long-would-it-take-to-travel-to-the-nearest-star/
  2. http://www.space.com/24701-how-long-does-it-take-to-get-to-mars.html
  3. https://en.wikipedia.org/wiki/New_Horizons
  4. https://www.google.com
  5. http://www.mercurynews.com/science/ci_28530317/nasa-finds-earth-sized-planet-around-sun-like
  6. http://www.ascensionnow.co.uk/our-solar-system.html (picture)
  7. http://www.space.com/16533-pluto-new-horizons-spacecraft-pictures.html (picture)
  8. https://en.wikipedia.org/wiki/Oort_cloud (picture)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।